সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা সৃষ্টিকারীরা সমাজশত্রু—-অধ্যক্ষ এম ইব্রাহীম আখতারী।
সমাজতত্ত্বে (Sociology) সম্প্রদায় (Community Society) একটি ইতিবাচক পরিভাষা। এটি দিয়ে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে চিত্রিত করা হয়েছে। এটি কোনভাবেই নিন্দনীয় পরিভাষা নয়। একটি রাষ্ট্র বা সমাজে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অস্থিত্ব থাকবে এটিই প্রাকৃতিক। যেথায় বসবাস করবে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, চাকমা, মার্মা, মুরুং,গারোসহ নানান জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, হে মানবগোষ্ঠী! “আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হও। নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সেই সবচেয়ে সম্মানিত, যে সর্বাধিক পরহেজগার। (সূরা-আল হুজরাত, আয়াত-১৬)। অতএব
এক্ষেত্রে মানুষে-মানুষে কোনপ্রকার অবাঞ্ছিত ভেদাভেদ-বিদ্বেষ এবং বিভক্তি-বিভাজন এর অবকাশ থাকতে পারে না। অধিকন্তু যেথায় প্রত্যেক সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে থাকবে পারস্পরিক ধর্মনিষ্ঠাসমেত সদ্ভাব ও সৌহার্দ্যবোধ। থাকবে সকলের মধ্যে উদার দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন দরদ-মমত্ববোধ এবং সাম্য-মৈত্রীর সেতুবন্ধন। উপরন্তু সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হবে ঐক্য ও সংহতি। আর এটিই হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। স্মরণাতীতকাল থেকেই এদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য মডেল ও দৃষ্টান্ত হিসেবে বিশ্ব পরিমণ্ডলে সমধিক পরিচিত। এদেশের মানুষের নিকট অবাঞ্ছিত সাম্প্রদায়িকতা একেবারেই পরিত্যাজ্য। কস্মিনকালেও এদেশে সাম্প্রদায়িকতার মত এ জঘন্য বিষয় জেঁকে বসতে পারেনি। ৯০ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত এদেশে সকল ধর্মের মানুষের পারস্পরিক
সহাবস্থান বিষ্ময়ের বিষ্ময়। এদেশে একজন মুসলমান যতটুকু অধিকার পায়, ততটুকু অধিকার পায় একজন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীও। এদেশে সরকারি চাকুরীতে প্রায় ২৫% ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের অবস্থান দৃশ্যমান হয়। এছাড়াও রাষ্ট্রীয় উচ্চ পর্যায়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে শোভাবর্ধন করছে এদের অসংখ্যজন। এদেশে সকল ধর্মাবলম্বী মানুষ ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা ও নিরুপদ্রবভাবে পালন করে থাকে স্ব স্ব পালাপার্বণ ও ধর্মীয় উৎসব। এদেশে যেমন মুসলিমদের জন্য মসজিদ ভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু আছে, অনুরূপভাবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্যও সরকারি অর্থায়নে মন্দির ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠাগার চালু রয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মগুরুর নামে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। খৃস্টান ধর্মাবলম্বীদের জন্য গঠন করা হয়েছে ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট। আর উপজাতি অধ্যুষিত পার্বত্যাঞ্চলে রয়েছে তাদের নিজস্ব ধর্মীয় ও জাতিগত নানাবিধ কেন্দ্র। অথচ দেশদ্রোহী একটি দুষ্টচক্র আড়ালে-আবডালে ওঁৎ পেতে থেকে এদেশে শিশাঢালা প্রাচীরের ন্যায় প্রতিষ্ঠিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে বহুমাত্রিক চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। এরা সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা সৃষ্টি করে অস্থিতিশীলতা তৈরির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এদেশকে একটি সন্ত্রাসী ও জঙ্গি রাষ্ট্র হিসেবে চিত্রিত করার জন্য আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছে। যার অশুভ শিকার হচ্ছে কুমিল্লার নালুয়া ট্রাজেডি। বিগত ১৩ অক্টোবর ‘২১ ইং হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বৃহত্তম ধর্মীয় অনুষ্ঠান দুর্গাপূজার সপ্তমীর দিন। কুমিল্লার নালুয়ার একটি পূজামণ্ডপে ঘটে গেল এক ন্যাক্কারজনক ঘটনা। মণ্ডপে স্থিত দেবি হনুমানের পায়ের উপর অত্যন্ত দূঃখজনকভাবে পাওয়া গেল মুসলমানদের মহান ঐশীগ্রন্থ পবিত্র আল কোরআন। স্বভাবতই এ মর্মান্তিক ঘটনা কেবল মুসলমান কেন যে কোন ধর্মের হলেও তা সে ধর্মাবলম্বীদের আহত করবে। এটি যার মাধ্যমেই সংঘটিত হোক না কেন নিঃসন্দেহে তা নিন্দনীয় এবং গর্হিত অপরাধও বটে। অতঃপর এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের একাধিক স্থানে ঘটে গেল নারকীয় তাণ্ডবলীলা। নির্বিচারে চালানো হলো বিভিন্ন পূজামণ্ডপে হামলা-ভাংচুর। একাধিক স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘরসহ বিভিন্ন স্থাপনায় অগ্নিসংযোগের মত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনারও অবতারণা হয়। যে ধারাবাহিকতায় হাজিগঞ্জে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিতে হলো তরতাজা ৫জন নিরীহ মানুষকে। তবে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিবিধ কুশলি ভূমিকায় বড় ধরণের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা থেকে রক্ষা পায় দেশ ও জাতি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এসব গর্হিত কাজের নেপথ্যে কুশীলব কারা? কাদের স্বার্থ সুরক্ষায় কিংবা কার এজেন্ডা বাস্তবায়নে এসব হীন কাজ। কেনই বা রক্তাত্ত হলো স্বাধীন বাংলার জনপদ। যারা এ কাজের সাথে জড়িত এদের কোন ধর্মাবলম্বী বলা যাবে না, নিদেনপক্ষে এদের সন্ত্রাসী ও দেশদ্রোহী বলা যেতে পারে। কেননা কোন ধর্মই এহেন নাশকতামূলক কাজকে সমর্থন করতে পারে না। ইসলাম শান্তি-সম্প্রীতির ধর্ম। উদারতা ও পরমত সহিষ্ণুতার ধর্ম। সাম্য ও মানবতা ইসলামের অনন্য বৈশিষ্ট্য। অন্যায়ভাবে ভিন্ন ধর্মের লোককে আঘাত করা, বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেয়া, উচ্ছেদ করা, স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করা ইসলামের শিক্ষা নয়। ইসলাম সকল সময় ও পরিস্থিতিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে শ্রদ্ধাশীল। ইসলাম স্বীয় কটাক্ষকে যেমনিভাবে পছন্দ করে না তদ্রুপ অন্য কোন ধর্মের অবমাননাকেও সমর্থন করে না। প্রসঙ্গতঃ প্রিয় নবী (দঃ) বলেছেন- যারা
মানুষকে সাম্প্রদায়িকতার দিকে আহ্বান করে, যারা সাম্প্রদায়িকতার জন্য যুদ্ধ করে এবং সাম্প্রদায়িকতার জন্য জীবন উৎসর্গ করে তারা আমার সমাজভুক্ত নয় (আবু দাউদ)। ইসলামের সোনালী শাসনামলেও ইসলামী শাসকগণ অমুসলিমদের অধিকার সংরক্ষণ করে গেছেন। ভারতবর্ষ ও স্পেনে দীর্ঘসময় ইসলামী শাসন চালু ছিল। মুসলিম শাসনের পতনের পর এসব দেশে তখনকার ন্যায় অদ্যাবধি অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্টতা বিদ্যমান রয়েছে। এতে প্রতীয়মান হয় যে, মুসলিম শাসকগণ ক্ষমতাকে নিরংকুশ অনুকূলে রাখতে অমুসলিমদের উপর কোন দমন-পীড়ন চালানোর চেষ্টা করে নি। পবিত্র হাদিস শরিফে প্রিয় নবী (দঃ) ইরশাদ করেছেন,-যে ব্যক্তি ইসলামী রাষ্ট্রের কোন অমুসলিম নাগরিককে কষ্ট দেবে আমি স্বয়ং তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেব এবং কেয়ামত দিবসে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করব। এছাড়াও আল্লাহ বলেছেন- আমি মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ (দঃ) কে প্রেরণ করেছি তাবৎ মানবজাতির জন্য কল্যাণস্বরূপ। সুতরাং সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিম জনপদে অমুসলিমদের জান-মাল, ইজ্জত -আব্রুর সঠিক নিরাপত্তার অপরিহার্য দায়িত্ব বর্তায় মুসলমানদের উপর। অনস্বীকার্য বাস্তবতা হলো, মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম সকল ধর্মের প্রতিনিধির সমন্বয়ে মদিনা সনদ প্রনয়নের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িকতার অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (দঃ)। যা ছিল বিশ্ব ইতিহাসে প্রথম লিখিত সংবিধান এবং শান্তি ও সম্প্রীতির এক ঐতিহাসিক দলিল। যেথায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষাসহ অমুসলিমদের অধিকার সম্পর্কিত বেশ কিছু ধারা সন্নিবেশিত রয়েছে।
যেমন- সনদে স্বাক্ষরকারী সব গোত্র-সম্প্রদায় ‘মদিনা রাষ্ট্রে’ সমান অধিকার ভোগ করবে। সকল সম্প্রদায়ের স্ব স্ব ধর্ম-কর্ম পালনের স্বাধীনতা ও অধিকার যথারীতি বহাল থাকবে। কেউ কারও ওপর কোন অবাঞ্ছিত আক্রমণ করবে না। কোন সম্প্রদায় বহিঃশত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হলে উক্ত সম্প্রদায়কে সম্মিলিত সহযোগিতা করাসহ শত্রুপক্ষকে প্রতিহত করতে হবে। কোন নাগরিক কর্তৃক কোন অপরাধ সংঘটিত হলে তা নিছক ব্যক্তিগত অপরাধ বলে গণ্য করা হবে (সিরাতে ইবনে হিশাম)। সুতরাং উপরোল্লিখিত বিষয়সমূহ দ্বারা আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষার নির্দেশনা চমৎকারভাবে প্রতীয়মান হয়। অমুসলিমদের প্রতি প্রিয় নবী (দ.) এর এ দৃষ্টিভঙ্গি যেমন বিশ্বজনীন, তেমনি সকল পরিস্থিতি ও সময়ের জন্য তা প্রযোজ্য এবং কার্যকর। এছাড়াও আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমাকে ছেড়ে যাদের তারা (মূর্তিপূজক) ডাকে, তাদের তোমরা গালি দিও না। তাহলে তারা সীমালংঘন করে অজ্ঞানতাবশত আল্লাহকেও গালি দেবে (সূরা আনয়াম : ১০৮)। অতএব, ধর্মের নামে জোর- জবরদস্তি, বল প্রয়োগ, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি জুলুম-অত্যাচার ইসলাম স্বীকৃত নয়।
এমনকি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মগ্রন্থ, উপাসনালয় ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে কোনোরূপ ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করাও ইসলাম সমর্থন করে না। তাই যারা সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা সৃষ্টি করে, সাম্প্রদায়িকতা উসকে দেয়, শান্তি-সম্প্রীতি বিনষ্ট করে দেশের সুস্থতা ও স্থিতিশীলতা বিধ্বংসী কাজের অপপ্রয়াস চালায়, সর্বোপরি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে, এদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করা খুবই জরুরী। এছাড়াও এ অপশক্তিকে দ্রুত খুঁজে বের করে গ্রেপ্তারপূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ দেশ বিরোধী এসব কর্মকাণ্ডের পুনরাবৃত্তির দুঃসাহস করতে না পারে।
সূত্রঃ ২৭শে অক্টোবর’২১ইং দৈনিক পূর্বকোণ পত্রিকা।
[related_post themes="flat" id="1739"]